TarkataZ

🌿 নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়: বাংলা কীর্তন ও কৃষ্ণ যাত্রার শেষ কিংবদন্তি 🎶

বাঙালি বাউল গান ও লোকসংস্কৃতির অঙ্গনে সাধক
নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়ের নাম এক অনন্য উচ্চতায় রয়েছে। তিনি কেবল একজন গীতিকার নন,বরং এক দার্শনিক যিনি বাউল গানের মধ্যে দিয়ে আত্মার পরমার্থ ও জীবনের গভীরতম সত্যকে তুলে ধরেছেন। তাঁর লেখা ও সৃষ্টির মধ্যে বাংলা বাউল গানের আধ্যাত্মিকতা ও মানবতাবাদ মূর্ত হয়ে ওঠে।

👉 জীবনী :

১৮৮২ সালে দুর্গাপুর-ফরিদপুর ব্লকের ধবনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন নীলকন্ঠ মুখোপাধ্যায়। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হয়েছিলেন।

অভাবের সংসারে রুটিরুজির টানে কলকাতায় এক মাড়োয়ারির বাসনের দোকানে কাজে নিযুক্ত হয়েছিলেন। সেখানে নিয়োগকারী রক্ষিতার কাছে সঙ্গীত শেখেন। তাঁর শিল্পী সত্তা দেখে সেখান থেকেই এক যাত্রাদলের মালিক তাঁকে যাত্রার দলে নিযুক্ত করেন। সেখানে তিনি অত্যন্ত সুখ্যাতি অর্জন করেন।

তারপরে সংগীতবিদ্যা নিয়ে গ্রামে ফিরে তিনি নিজের এক দল গঠন করেন। দিন দিন স্বভাবকবি নামে তাঁর পরিচিতি আরও বাড়তে থাকে। যেখানে যা দেখতেন তাই নিয়েই তৎক্ষনাৎ কবিতা বানিয়ে ফেলতেন। আবার তখনই ওই কবিতায় সুর চড়িয়ে গানও বেঁধে ফেলতেন। তাঁর এই প্রতিভা মুগ্ধ করত শ্রোতাদেরও।

তাঁর প্রতিভার জন্য হেতমপুর রাজার অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন তিনি। তিনি রাজার রাজসভার সভাকবি হিসেবেও ছিলেন একসময়। কন্ঠমশায় তাঁর সুরেলা কন্ঠে ও লেখনি গুনে খুব অল্প সময়েই ব্যাপক ক্ষ্যাতি অর্জন করে ফেলেছিলেন। পাশাপাশি বিপুল সম্পত্তির অধিকারীও হয়ে উঠেছিলেন।

তিনি যাত্রা লিখতেন, যাত্রার গান লিখতেন। দলবলে শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শনাভিলাষী হয়ে দক্ষিণেশ্বরও গেছেন। বর্ধমান নিবাসী এই কবির রচনায় পাঁচালীকার দাশরথি রায়ের সুস্পষ্ঠ ছাপ রয়েছে। নীলকন্ঠ মুখোপাধ্যায়ের গান ‘কণ্ঠের পদ’ নামে সুখ্যাত ছিল।

তাঁর এক বংশধর বলেন, "কন্ঠমশায়ের মধ্যে ঐশ্বরিক শক্তি বিরাজমান ছিল। তাঁর সুরে ও কন্ঠে মুগ্ধ হতেন স্বয়ং ভগবানও। কন্ঠমশাইয়ের গান শুনে প্রশংসা করেছিলেন স্বয়ং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব মহাশয়ও।" কন্ঠমশাইয়ের ছেলে ছিলেন কমলাকান্ত মুখোপাধ্যায়। আবার তাঁর ছেলে দুর্গাদাস মুখেপাধ্যায়।

দুর্গাদাসবাবুর সাত ছেলেরা হলেন বর্তমান চতুর্থ বংশধর। চতুর্থ বংশধরের এক ছেলে গনেশ মুখোপাধ্যায় বলেন, "মৃত্যুর পূর্বে কন্ঠমশাইয়ের করা ভবিষ্যৎবাণী এক্কেবারে মিলে যায়। নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তার অর্জন করা বিপুল সম্পত্তি। কন্ঠমশাই ১৯১১ সালে ত্রিবেণীর গঙ্গায় নিজের ইচ্ছামৃত্যু বরণ করেন। ইচ্ছামৃত্যু বরণের পূর্বে তিনি বলে গিয়েছিলেন তার এই বিষয় সম্পত্তি কিছুই থাকবে না। হতদরিদ্র হবে এই পরিবার। তবে বংশ রক্ষা হবে।

নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়ের জীবন বাউল সাধনার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। ছোটবেলা থেকেই তিনি লোকগান ও ধর্মীয় গানের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। বাউল গানের স্রষ্টাদের মধ্যে নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায় নিজস্ব দর্শন ও আধ্যাত্মিক চেতনার গভীর ছাপ ফেলেছেন। তাঁর গানে রয়েছে মানবজীবনের বৈচিত্র্য, দুঃখ-কষ্ট এবং আশার প্রতিফলন।

নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায় বিশ্বাস করতেন, বাউল গান হলো শুধু গানের আনন্দ নয়, এটি জীবনের সত্যকে উপলব্ধি করার একটি মাধ্যম। তাঁর গানে আমরা খুঁজে পাই মনের মুক্তি, ভগবানের সাথে আত্মার সংযোগ, এবং প্রেমের চিরন্তন দর্শন। তাঁর গানগুলোতে গুরু-শিষ্য সম্পর্ক, আত্ম-অন্বেষণ এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির অনন্য মিশ্রণ দেখা যায়, যা তাঁকে একজন প্রবাদপ্রতিম বাউল গীতিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

👉 কর্মজীবন ও রচনাসমূহ

নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়ের কর্মজীবনে "কংসবধ," "যযাতিযজ্ঞ," এবং "চণ্ডালিনী উদ্ধারের" মতো বিখ্যাত যাত্রাগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই যাত্রাগুলি তখনকার সময়ে বেশ জনপ্রিয় ছিল এবং গ্রামবাংলার লোকজ সংস্কৃতির একটি প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এসব যাত্রাগুলি ভক্তি, ধর্মীয় আদর্শ, এবং কৃষ্ণভক্তির প্রতি মানুষের গভীর আকর্ষণ ফুটে উঠত।

নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায় রচনা করেছেন অগণিত বাংলা কীর্তন গান, যা আজও কীর্তনিয়া সমাজ, কৃষ্ণভক্তদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাঁর গানগুলিতে গভীর ধর্মীয় ভাবনা ও আধ্যাত্মিকতা প্রকাশিত হয়েছে, যা বাউল গানেও প্রভাব ফেলেছে। তাঁর রচিত গানগুলি এখনও বাউলরা তাঁদের ধর্মীয় ভক্তি প্রকাশের জন্য গেয়ে থাকেন।

👉 গানের তালিকা

নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়ের কিছু উল্লেখযোগ্য গানের তালিকা নিম্নরূপ:

◆ মন ভাবিলে বল কি হবে
◆ কত দিনে দীনহীনের ভাব ধরবে আমার মন
◆ হরিনাম লিখে অঙ্গে দেরে
◆ মান সাগরে
◆ আমার নাম কালো কৃষ্ণ বেদে
◆ হরি তোমার সর্বরূপ মাতৃরূপ সার
◆ হরি দুখ দাও যে জনা রে
◆ কতদিনে হবে সে প্রেম সঞ্চার

এই গানগুলির মূল বৈশিষ্ট্য হলো, এগুলিতে ভক্তি ও আধ্যাত্মিকতার গভীর বাণী প্রকাশ পেয়েছে। "আমার নাম কালো কৃষ্ণ বেদে" এবং "হরি তোমার সর্বরূপ মাতৃরূপ সার" গানগুলো বিশেষভাবে কৃষ্ণভক্তদের মধ্যে প্রচলিত। এগুলির মধ্যে কৃষ্ণপ্রেম ও ভক্তির গভীরতা ফুটে ওঠে, যা মানুষকে ভাবজগতে নিয়ে যায়।

👉 বাংলা কীর্তন ও বাউল গান: সাংস্কৃতিক প্রভাব

নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়ের লেখা গানগুলি শুধু কীর্তনিয়াদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; এগুলির প্রভাব বাংলা লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন ধারায় ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁর লেখা "বাংলা কীর্তন গান" কৃষ্ণভক্তদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়, এবং বাউলদের মধ্যে তাঁর গানগুলি মানসিক মুক্তির প্রতীক হয়ে আছে। বাংলা কীর্তন ও বাউল গানের মধ্যে তাঁর সৃষ্টির গভীর প্রভাব স্পষ্ট। "বাউল গানের গীতিকার" হিসেবে তাঁর অবদান আজও সমানভাবে মূল্যায়িত।

👉 বাউল গানের দার্শনিকতা:

নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়ের গানগুলোর মূল বৈশিষ্ট্য হলো এর আধ্যাত্মিক গভীরতা। বাউল গানের মাধ্যমে তিনি জীবনের মূল রহস্য এবং মানবাত্মার উদ্দেশ্যকে ব্যক্ত করেছেন। তাঁর গানে মানবিক প্রেম, বিশ্বাস, এবং ভক্তির প্রতি এক অপরিসীম অনুরাগ ধরা পড়ে। নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়ের দার্শনিক চিন্তা বাংলার লোকসংস্কৃতির মধ্যে আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।

👉 বাউল গানের মধ্যে নীলকণ্ঠের অবদান:

নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়ের গানগুলো আজও বাংলার বিভিন্ন বাউল আখড়ায় গাওয়া হয়। তাঁর রচনাগুলি শুধুমাত্র বাংলার বাউল সাধকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি বাংলা লোকসংস্কৃতির একটি মূল্যবান অঙ্গ। বাউল গীতিকার হিসেবে তাঁর গানগুলির মধ্য দিয়ে আমরা বাংলার গ্রামীণ জীবনের সরলতা, ভক্তি, এবং আধ্যাত্মিকতার রূপ দেখতে পাই।

নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায় তাঁর গানের মধ্যে দিয়ে বাউল সঙ্গীতকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছেন। তাঁর সৃষ্টি এবং দার্শনিকতা বাংলার বাউল ও লোকসংস্কৃতির ইতিহাসে এক স্থায়ী চিহ্ন রেখে গেছে।

👉 প্রশ্নোত্তর:

প্রশ্ন:নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায় কী ধরনের গান লিখতেন?

উত্তর:নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায় ভক্তিমূলক বাংলা গান লিখতেন, যা আধ্যাত্মিকতা, প্রেম, এবং মানবজীবনের গভীর দর্শনের উপর ভিত্তি করে ছিল।

প্রশ্ন:নীলকণ্ঠের গানগুলো বাংলার কোথায় জনপ্রিয়?

উত্তর:তাঁর গানগুলি বিশেষত বাংলার গ্রামীণ অঞ্চলে বাউল সাধকদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়। এছাড়া বাউল আখড়াগুলিতেও তাঁর গানগুলি প্রচুর পরিমাণে গাওয়া হয়।

প্রশ্ন:নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়ের দার্শনিক চিন্তার মূল উপাদান কী?

উত্তর:নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়ের দার্শনিক চিন্তার মূল উপাদান ছিল কৃষ্ণ ভক্তিমূলক, আত্মার মুক্তি, গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক, এবং মানবজীবনের অন্তর্নিহিত সত্য।

✒️কলমে - সৌভিক রায়

#NilakanthaMukhopadhyay
#Nilkanthamukhopadhyaygaan
#nilkanthamukhopadhyayimage
#Neelkanthmukhopadhyaygaan #dhabani
#Durgapur #nilkantha #kirtan #Banglakirtan
#krishna #krishnalove #krishnaconsciousness
#bengalipoetry #bengalipoetrycommunity
#songwriter #songwriterlife #folkmusician

6 months ago (edited) | [YT] | 8